ব্লুম-এর বর্গীকরণটিকে নীচে আলোচনা করা হল-
A. জ্ঞানমূলক ক্ষেত্র (Cognitive Domain) :
জ্ঞানমূলক ক্ষেত্রটি শিক্ষার্থীদের মানসিক দক্ষতার সঙ্গে সম্পর্কিত। Blooms-এর মতে, Cognitive domain includes those objectives which deal with recall or recognition of knowledge and the development of intellectual abilities and skills, এই ক্ষেত্রটির ছয়টি স্তর আছে। সেগুলো হল –
1. জ্ঞান (Knowledge) : জ্ঞানমূলক মাত্রার সর্বনিম্ন পর্যায় হল জ্ঞান। এই মাত্রার অন্তর্ভুক্ত হল বিষয়ের পুনরুদ্রের, (প্রত্যভিজ্ঞা, ধারণার প্রক্রিয়াকরণ, সূত্র সামান্যীকরণ যা তরে রূপ নেয় ইত্যাদি। জ্ঞানকে ত্রুটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন –
(a) নির্দিষ্টতার জ্ঞান
(b) পদ্ধতি সম্পর্কে জ্ঞান
(c) বিমূর্ত জ্ঞান
2. বোধগম্যতা (Comprehension) : জ্ঞানমূলক উদ্দেশ্যের ক্রমপর্যায়ের দ্বিতীয় স্তরে এর অবস্থান। এই স্তরে প্রত্যাশা করা হয় যে, শিক্ষার্থী কোনো ঘটনা, বস্তু, তত্ত্ব ইত্যাদি সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা অর্জন করে। বোধকে এটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। যেমন –
(a) রূপান্তরকরণ
(b) মন্তব্যকরণ
(c) জানা থেকে অজানাকে অনুমান করা
3. প্রয়োগ (Application) : আনমূলক মাত্রার তৃতীয় স্তর হল প্রয়োগ। এখানে শিক্ষার্থী ঘটনা, তথ্য, ধারণা সম্পর্কে যা বুঝেছে তাকে নতুন পরিস্থিতিতে ব্যবহার করে। অর্থাৎ শিক্ষার্থী তার অর্জিত জ্ঞানকে নতুন সমস্যাসমাধানে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়।
যেমন – আর্কিমিডিস এর নীতি জানার পরে একটি ক্ষুদ্র ছুঁচ জলে ডুবে যায়, কিন্তু বড়ো জাহাজ ভেসে থাকার কারণ ব্যাখ্যা করতে শিক্ষার্থী সক্ষম হবে।
4. বিশ্লেষণ (Analysis) : এখানে প্রত্যাশা করা হয় যে, শিক্ষার্থী তথ্য, ঘটনা ও সমস্যাকে বোঝার জন্য এগুলিকে কয়েকটি অংশে ভাগ করাতে পারবে এবং অংশগুলির মধ্যে সম্পর্ক বুঝতে পারবে। এটি গুটি ভাগে বিভক্ত। যেমন –
(a) উৎপাদনের বিশ্লেষণ
(b) সম্পর্কের বিশ্লেষণ
(c) সাংগঠনিক নীতিসমূহের বিশ্লেষণ
5. সংশ্লেষণ (Synthesis) : সংশ্লেষণ বলতে বোঝায় কোনো ধারণার উপাদানগুলিকে সামগ্রিক রূপ দেওয়ার জন্য অংশগুলিকে বিন্যস্ত ও সমন্বিত করা। এর মধ্যে সৃজনশীলতার উপাদান বর্তমান। এই উদ্দেশ্যের 3টি শ্রেণি আছে। যেমন –
(a) প্রভাবিত কার্যধারা বা পরিকল্পনা রচনা করা
(b) অনন্য যোগাযোগের ব্যবস্থা করা
(c) বিমূর্ত সম্পর্ক স্থাপন করা
6. মূল্যায়ন (Evaluation) : মূল্যায়ন হল আনমূলক মাত্রার সর্বোচ্চ শ্রেণি। গুণগত বা পরিমাণগতভাবে কোনো কাজ সমাধান, পদ্ধতি, চিন্তা, বস্তু ইত্যাদির মূল্যায়ন বিবেচনা করা মূল্যায়ন উদ্দেশ্যে। মূল্যাদান উদ্দেশ্যের ২টি অংশ আছে। যেমন –
(a) অভ্যন্তরীণ প্রমাণাদির দ্বারা বিচারকরণ
(b) বাহ্যিক নির্ণায়কের দ্বারা মূল্যায়ন
B. অনুভবমূলক ক্ষেত্র ( Affective Domain) :
অনুভবমূলক ক্ষেত্রটি শিক্ষার্থীর অনুভূতি ও মনোভাবের সঙ্গে সম্পর্কিত। এই ক্ষেত্রটি Bloom, Krathwohl এবং Masia প্রস্তুত করেন। তাদের মতে, “Affective domain includes those objectives which are concerned with changes in interests, attitudes and values and the development of appreciation and adjustment.” এই ক্ষেত্রটির পাঁচটি স্তর আছে-
1. গ্রহণ করা (Receiving) : এটি অনুভূতিমূলক মাত্রার সর্বনিম্ন শ্রেণি। নির্দিষ্ট উদ্দীপকের প্রতি শিক্ষার্থীর অনুভূতি এই তবে বিবেচিত হয় অর্থাৎ শিক্ষার্থী নির্দিষ্ট উদ্দীপক গ্রহণ বা তার প্রতি মনোযোগী হতে ইচ্ছুক কিনা । তথ্যের প্রতি সচেতনতা, তথ্যগ্রহণে শিক্ষার্থীর প্রস্তুতি এবং মনোযোগের নির্বাচনধর্মিতা এই স্তরে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই শ্রেণিটি শিক্ষার্থীদের শিখন কেন্দ্রিকতার স্তর
2. প্রতিক্রিয়াকরণ (Responding) : সচেতনতা ও মনোযোগের পরবর্তী উচ্চতর হল প্রতিক্রিয়াকরণ স্তর। এই স্তরে প্রেরণা এবং নিয়মিত মনোযোগের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। এখানে নির্দিষ্ট বস্তু বা উদ্দীপকের প্রতি প্রতিক্রিয়াকরণে আগ্রহ সম্বার করা হয়। আগ্রহ তিনটি পর্যায়ে কাজ করে।
(a) প্রত্যাশিত কাজ করা, যেমন— স্বাস্থ্যবিধির কথা মেনে চলার ইচ্ছা প্রকাশ করা।
(b) ইচ্ছাপ্রসূত প্রতিক্রিয়া, যেমন—শিক্ষার্থীর নিজের এবং অন্যের স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন নেওয়া।
(c) আনন্দের সঙ্গো প্রতিক্রিয়া করা, যেমন—অসুস্থ ব্যক্তির পরিচর্যা করে আনন্দ অনুভব করা।
3. গুরুত্ব নির্ধারণ (Valuing) : এটি অনুভূতিমূলক মাত্রার তৃতীয় স্তর। এই স্তরের বৈশিষ্ট্য হল নির্দিষ্ট আদর্শ ও মূল্যবোধের প্রতি আনুগতা ও মনোভাব গঠন করা।
উদাহরণ হল – বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ ঘটানো। যার ফলে অন্যের মতামত অপেক্ষা বাস্তব প্রমাণ সংগ্রহ করে কোনো কিছু বিচার করা, কুসংস্কার বর্জন করা, বিচারের জন্য যতক্ষণ না পর্যন্ত পর্যাপ্ত প্রমাণ পাওয়া যায় ততক্ষণ পর্যন্ত বিচার স্থগিত করা ইত্যাদি। এই ধরনের মনোভাব বিকাশের ফলে ব্যক্তির বিবেক জাগ্রত হয় যা তার আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে।
4. সুসংবদ্ধকরণ (Organization) : এই স্তরে মূল্যবোধগুলি গঠিত হয়। এখানে মূল্যবোধগুলি ধারণাকৃত হয়। মূল্যবোধ সংক্রান্ত অন্তদ্বন্দ্বের সমাধান হয় এবং মূল্যবোধের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক তৈরি হনা। এই ভরে অনুভূতিমূলক আচরণে জ্ঞানমূলক মাত্রার বিশ্লেষণ ও সংশ্লেষণগত আচরণ অন্তর্ভুক। ব্যক্তির নিজস্ব আচরণবিধি অথবা সাধারণ জনগণের নৈতিক মান হল মূল্যবোধের ব্যবস্থা গঠনের উদাহরণ।
5. চরিত্রায়ন (Characterization) : চরিত্রায়ন হল অনুভূতিমূলক মাত্রার সর্বোচ্চ স্তর। এই স্তরে মূল্যবোধ, বিশ্বাস বা চিন্তাধারাকে কেন্দ্র করে ব্যক্তির আচরণ নিয়ন্ত্রিত হয়। মূল্যবোধ এবং চরিত্রায়নের সমন্বিত রূপই হল ব্যক্তির জীবন দর্শন।
উল্লেখ্য, অনুভূতিমূলক মাত্রার Taxonomy, সর্বদা উর্ধ্বক্রমিক নীতি অনুযায়ী বিন্যস্ত নাও হতে পারে, তবে গ্রহণ (Receiving) থেকে চরিত্রায়ন (Characterisation) স্তর যে ক্রমশ জটিল সে সম্পর্কে কোনো দ্বিমত নেই।
C. মনোস্যালনমূলক ক্ষেত্র (Psychomotor Domain)
মনোসন্দালনমূলক ক্ষেত্রটি শিক্ষার্থীর শারীরিক দক্ষতার সঙ্গে সম্পর্কিত। Simpson, Kibler, Harrow এবং Dave এই ক্ষেত্রটিকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে প্রস্তুত করেন। তাদের মধ্যে Simpson এর তৈরি ক্ষেত্রটি সর্বাপেক্ষা গ্রহণযোগ্য। তাঁর মতে, “Psychomotor domain includes those objectives which deal with manual and motor skills এই ক্ষেত্রটির সাতটি স্তর আছে –
1. প্রত্যক্ষণ (Perception) : শিক্ষার প্রথাগতকালে প্রাথমিক মানসিক প্রক্রিয়াই হল প্রত্যক্ষণ। কোনো উদ্দীপকের উদ্দীপনা দর্শন, শ্রবণ, স্পর্শ ইত্যাদি ইন্দ্রিয়কে কাজে লাগিয়ে যখন স্নায়ু কেন্দ্রে পৌঁছোয় তখন প্রাথমিক সংবেদন প্রত্যক্ষণে পরিণত হয়। প্রত্যক্ষণ শুধু শোনা বা দেখা নয়। প্রত্যক্ষণ বলতে ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতিকে বোঝানো হয়। এর স্তর তিনটি হল –
(a) সংবেদন উদ্দীপনা
(b) ইঙ্গিত নির্ধারণ
(c) রূপান্তরকরণ
2. তাৎক্ষণিক প্রস্তুতি (Set) : এটি হল এই ক্ষেত্রের দ্বিতীয় ধাপ। এটি আরও জটিল কাজের সঙ্গে যুক্ত। এই স্তরের মূলকথা হল কোনো কাজ করার জন্য প্রস্তুত হওয়া এবং এই প্রস্তুতির জন্য বিভিন্ন প্রকার পরিস্থিতির সঙ্গে সংগতিবিধান করতে শেখা।
3. নিয়ন্ত্রিত প্রতিক্রিয়া (Guided Response) : এই স্তরে ক্রিয়াকলাপ অভিজ্ঞতাকে হাতেকলমে প্রয়োগ করার ক্ষেত্র প্রস্তু করে। সহজ কথায়, অন্য কোনো ব্যক্তি পরিচালনায় বাহ্যিক আচরণের প্রকাশ এই স্তরে হয়ে থাকে। এই স্তরে, অনুকরণ বা প্রচেষ্টা ও ভুল পদ্ধতির মাধ্যমে শিখন হয়ে থাকে এবং উদ্দেশ্য পরিমাপ করা হয়ে থাকে নির্দেশক বা অন্য কোনো স্থিরীকৃত শর্তের মাধ্যমে।
4. কৌশল (Mechanism) : শিক্ষার্থী প্রচেষ্টা ও প্রাপ্তির মাধ্যমে যখন কোনো সদালনমূলক কাজ করতে শেখে তখন ধীরে ধীরে সেই কাজের কৌশলটি শিখে ফেলে। সঠিক কৌশল শিখনে ওই কাজে শিক্ষার্থী অসফল হবে না। তাই শিক্ষার্থীর কৌশলটি শিখে ফেলা উচিত এবং এ ব্যাপারে শিক্ষক উপযুক্ত নির্দেশনা দেবেন।
5. জটিল বাহ্যিক প্রতিক্রিয়া (Complex Overt Response) : কৌশল আয়ত্ত কালেই ক্রিয়াগত বা সদালনমূলক উদ্দেশ্যের চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছোনো যাবে না। কোনো বিশেষ দক্ষতা অর্জনের জন্য একাধিক কৌশল থাকতে পারে। সেই কৌশলগুলি আয়ত্ত করে যদি ওই কৌশলসমূহের সমন্বয় করতে পারে তবে অপেক্ষাকৃত জটিল প্রক্রিয়া সম্পাদন করতে পারবে।
যেমন – কম্পিউটার শিখনের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা কি-বোর্ড, মাউস ইত্যাদির ব্যবহারের কৌশলগুলি যদি আয়ত্ত করতে পারে তবে সেই কৌশলগুলির সমন্বয়ে বিভিন্ন সমস্যা যেমন বিভিন্ন ধরনের চিত্র, গ্রাফ ইত্যাদি সহজেই করতে পারবে।
6. অভিযোজন (Adaptation) : শিক্ষাক্ষেত্রে ক্রিয়াগত বা সঞ্চালনমূলক কৌশলসমূহের সমন্বয়ে অপেক্ষাকৃত জটিল কৌশল শিখতে পারে শিক্ষার্থীরা। সুতরাং শিক্ষার্থীরা ওই কৌশল বা জটিল কৌশলকে কাজে লাগিয়ে আরও উচ্চতর পর্যায়ে দক্ষতা অর্জন করতে পারে, যেমন-একজন শিক্ষার্থী কাগজে ছোটো ছোটো বিভিন্ন ছবি আঁকতে শিখল এরপর তাতে যথাযথ রঙের ব্যবহারের কৌশল শিখল। এইভাবে সে ছবি আঁকায় দক্ষ হয়ে উঠল এবং তার এই দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে বড়ো সাইনবোর্ড আঁকতে পারছে। এই প্রক্রিয়াটি হল অভিযোজন।
7. সৃজন (Origination) : সকালনগত দক্ষতার কৌশলগুলি আয়ত্ত করার ফলে শিক্ষার্থীরা নতুন কৌশল সৃষ্টির প্রতি আগ্রহী হলে, তাদের মধ্যে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠবে। সুতরাং সঞ্চালনগত দক্ষতা ধীরে ধীরে সৃজনশীলতার স্তরে। পৌঁছোবে।