মানবজীবনের শৈশব কালের বিকাশগত বৈশিষ্ট্যাবলি ও চাহিদা (Characteristics and Needs of Infancy Stages of Human Development)
CDP for WB Primary TET, CTET, WBSSC TET & Others STET Exam Preparation in 2023.
শৈশব কাল
মানবশিশু জন্মায় একটি অপরিণত, অসহায় ও ক্ষুদ্র সত্তা নিয়ে। কিন্তু জন্মের পর থেকে পরিবেশের অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে তার নানা দিকে বিকাশ ও বৃদ্ধি হয়ে থাকে। তার জীবনবিকাশের ধারা অবিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়ায় এগিয়ে চলে। এই ধারাতে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত কয়েকটি তা লক্ষ করা যায়। বিকাশের এই স্বরগুলিকে বারির সহজাত গুণগুলির আত্মপ্রকাশই শুধু ঘটে না, সেগুলির একটা সুষ্ঠু সমন্বয় ঘটে। এর ফলে ব্যক্তি তার জীবনকে সহ ও সার্থক করে পরিণতির দিকে এগিয়ে চলে। বিভিন্ন স্বপ্নে গারির মধ্যে বিভিন্ন চাহিদা দেখা দেয়। নীচে জীবনবিকাশের প্রধান চারটি স্তরের (জোনসের স্বভাগ অনুযায়ী) বিকাশগত বৈশিষ্ট্য ও চাহি সম্পর্কে আলোচনা করা হল।
১. শৈশব কাল :
জন্মের পর থেকে পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত সময়কালকে শৈশৱকাল বলা হয়। এই শৈশবকালকে দুটি স্তরে বিভর করা হয়, যথা— প্রারম্ভিক শৈশব (1) প্রীয় শৈশব (2বছর-5 বছর) স্তর। শিক্ষাগত দিক নিয়ে এটি হল বিদ্যালয় স্তর। শিক্ষার ভিত্তি ও ব্যপ্তিত্ব গঠনে এই স্তরটি জীবনবিকাশে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
শৈশবকালের বৈশিষ্ট্য :
শৈশবকালের বিকাশগত বৈশিষ্ট্যগুলি প্রধানত চারটি ভাগে বিভক্ত, এই জীবন বিকাশের ভাগগুলো হলো –
(ক) দৈহিক বিকাশ
(খ) মানসিক বিকাশ,
(গ) সামাজিক বিকাশ
(ঘ) প্রাক্ষোভিক বিকাশ।
জীবনবিকাশের এই স্তরে শিশুর এই চার ধরনের বিকাশই দ্রুত ঘটে।
(ক) দৈহিক বিকাশ : শিশুর দৈহিক বিকাশের ক্ষেত্রে যে বৈশিষ্ট্যগুলি লক্ষ করা যায়, সেগুলি হল—
(i) প্রারম্ভিক শৈশবে দৈহিক বিকাশ খুব দ্রুত ঘটে।
(ii) সদ্যোজাত শিশুর গড় উচ্চতা ও ওজন যথাক্রমে 17 ইঞ্চি থেকে 21 ইঞ্চি এবং ৮ থেকে ৪ পাউন্ড হয়।
(iii) এরপর সাধারণভাবে বছরে উচ্চতা হয় 38 ইনি এবং ওজন হয় 33 পাউন্ড।
(iv) প্রান্তীয় শৈশবে প্রারম্ভিক শৈশবের মতো দৈহিক বিকাশ দ্রুত ঘটে না। দৈহিক বৃদ্ধির মধ্যে একটা সমতা পরিলক্ষিত হতে শুরু করে। পায়ের দিকের বুদ্ধি খুব দ্রুত ঘটে এবং মোট উচ্চতার প্রায় অর্ধেক হয়। মাথার বৃদ্ধি ধীরে ঘটে এবং মধ্য অংশের বৃদ্ধি মাঝারি ধরনের হয়।
(v) পাঁচ বছরের মধ্যে বালকদের গড় ওজন ও উচ্চতা যথাক্রমে 43 পাউন্ড এবং 43 ইঞ্চি হয়। বালিকাদের উচ্চতা ও ওজন বালকদের থেকে সামান্য কম হয়।
(vi) দৈর্ঘ্য ও উচ্চতা ছাড়াও শিশুর মধ্যে আরও বিভিন্ন রকমের দৈহিক বিকাশ ঘটে। দীর্ঘ পেশিগুলি ক্ষুদ্র পেশিগুলির চেয়ে দ্রুত এবং সুষমভাবে বৃদ্ধি পায়। বিভিন্ন শারীরিক পরিবর্তনও ঘটে। যেমন—শ্বাসপ্রশ্বাস ও হৃদযন্ত্রের গতি হ্রাস পায়, রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়। এই বয়সের মধ্যেই মস্তিষ্কের প্রায় নব্বই শতাংশ গঠন সম্পন্ন হয়ে যায়। মস্তিষ্কের কাছাকাছি নায়ুতন্ত্রগুলি প্রাকৃবিদ্যালয়ের শেষদিকেই পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়।
(খ) মানসিক বিকাশ : মানসিক বিকাশকে দু-ভাবে ব্যাখ্যা করা যায়- ভাষার বিকাশ এবং বৌদ্ধিক বিকাশ।
(i) ভাষার বিকাশ : শিশুর ভাষার বিকাশ জন্মানোর সময় কান্নার মধ্যে দিয়েই শুরু হয়। দশ মাসের শিশু একটি শব্দ ব্যবহার করতে সক্ষম হয়, কিন্তু প্রথম বছরের শেষের দিকে তার শব্দভাণ্ডারে তিন থেকে চারটি শব্দ সন্বিত হয়। 6 বছরের শিশু প্রায় 2562টি শব্দ বলতে পারে।
(ii) বৌদ্ধিক বিকাশ : শিশুর বৌদ্ধিক বিকাশ দু-বছর ব্যাস থেকে দ্রুত ঘটে, কারণ এই বয়স থেকেই শিশু সমাজ-পরিবেশের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করে। বৌদ্ধিক বিকাশের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য হল –
(a) এই পর্যায়ে প্রাকৃতিক ও সামাজিক বাস্তবতা সম্পর্কে ধারণা গড়ে ওঠে।
(b) এই স্তরের শেষের দিকে বস্তুর আকার, গঠন, রং ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা গড়ে ওঠে।
(c) স্মৃতি খুব দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পায়। শিখনে স্মৃতির ব্যবহার খুব বেশি।
(d) শিশুর মধ্যে সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটে। কল্পনা করার ক্ষমতা প্রকাশ পায়।
(e) প্রত্যক্ষ বিষয়ভিত্তিক চিন্তার ও বিচার করার ক্ষমতার বিকাশ ঘটে।
(f) মনোযোগের পরিসর এবং পরিবেশকে জানার প্রতি কৌতূহল বৃদ্ধি পায়।
(g) এই বয়সে শিশু ভাষার সংকেত ব্যবহার করতে শেখে। খেলার বন্ধু আঁকতে পারে এবং ছোটোখাটো সমস্যা সমাধান করতে পারে।
(h) শিশু তার পরিবেশ সম্পর্কে নানা প্রশ্ন করে।
(গ) সামাজিক বিকাশ : শিশু সমাজ-পরিবেশের মধ্যেই জন্মগ্রহণ করে এবং তার বারিত্ব গড়ে ওঠে সমাজের প্রত্যাশা অনুযায়ী। এই পর্যায়ের বিভিন্নন্ন বৈশিষ্ট্য হল-
(i) এই স্তর থেকেই শিশুদের স্বাধীন চেতনার বিকাশ ঘটে। তারা নিজেরাই পরিবেশকে জানতে চায়।
(ii) গৃহের বাইরে সমাজ-পরিবেশের সঙ্গে শিশুর মিথস্ক্রিয়া শুরু হয়।
(iii) লিকাগত পার্থক্যের ওপর গুরুত্ব আরোপ না করে ছেলে ও মেয়েরা একত্রে খেলা করে। শারীরিক শাস্তির প্রয়োজন নেই এমন দলগত খেলা, যেমন— লুকোচুরি খেলায় সক্রিয় অংশগ্রহণ করে।
(iv) একে অপরের সঙ্গে সহযোগিতা করে, যৌথ স্বার্থের ভিত্তিতে বন্ধুত্ব করে।
(v) জীবজন্তু ও রূপকথার গল্পের প্রতি কৌতূহল দেখায়।
(vi) তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে ঋণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে। যে শিশু যত বেশি বয়স্কদের কাছ থেকে বাধা পায় তার আচরণে তত ঋণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটে।
(ঘ) প্রাক্ষোভিক বিকাশ : এই স্তরের শিশুদের প্রাক্ষোভিক বিকাশের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-
(i) প্রক্ষোন্ডের (ভাবাবেগ) খুব ঘন ঘন বহিঃপ্রকাশ হয়।
(ii) মূর্ত বা প্রত্যক্ষ বিষয়কে কেন্দ্র করে প্রক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
(iii) এই স্তরের প্রক্ষোভ খুবই অস্থায়ী। শিশুর প্রক্ষোভ খুব দ্রুত এক বস্তু থেকে অন্য বস্তুতে চলে যায়।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়—কলনরত শিশুকে একটি চকোলেট দিলেই সে আনন্দ প্রকাশ করে।
(vi) এই বয়সে উদ্দীপকের মাত্রা অনুযায়ী প্রক্ষোভের মাত্রা স্থির হয় না। সর্বদাই প্রক্ষোভ চড়া মাত্রায় থাকে।
(v) শিশুরা প্রক্ষোভ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। অনেক সময় নিজের অজান্তে প্রক্ষোভ প্রকাশ করে, যেমন- নখ খোঁটা, আঙুল চোষা, তোতলামি ইত্যাদি।
শৈশবের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অবহিত হওয়ার পরেই শিশুর শিক্ষা-পরিকল্পনা করা প্রয়োজন।
Q. শৈশব কালের চাহিদাগুলো কি কি আলোচনা করো ?
শৈশবকালের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী শিশুর মধ্যে বিভিন্ন চাহিদা দেখা যায়। এই চাহিদাগুলি শৈশবকালীন শিক্ষাব্যবস্থা অর্থাৎ প্রাকপ্রাথমিক শিক্ষান্তরে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। চাহিদাগুলির মধ্যে অন্যতম হল –
1. দৈহিক বা জৈবিক চাহিদা।
2. মানসিক চাহিদা।
3 সামাজিক চাহিদা।
1. জৈবিক চাহিদা :
জৈবিক চাহিদা বলতে এমন কতকগুলি চাহিদাকে বোঝায় যা শিশুকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে। এই চাহিদাগুলি হল—
(a) খাদ্যের চাহিদা :
শৈশবে দৈহিক বৃদ্ধি খুব দ্রুত হারে হয়ে থাকে। এই জন্য শিশুর খাদ্যের চাহিদা অত্যন্ত প্রবল হয়ে ওঠে। এই চাহিদাপুরণ তার ব্যক্তিত্ব বিকাশের স্বার্থে জরুরি। শুধু খাদ্য হলেই হবে না। প্রয়োজনমাফিক উন্নতমানের খাদ্য আবশ্যক।
(b) ঘুমের চাহিদা :
শিশুর ঘুমের চাহিদাও এই বয়সে প্রবল হয়। দ্রুত বৃদ্ধির জন্যই এই অতিরিক্ত ঘুমের চাহিদা দেখা যায়।
(c) নিরাপত্তার চাহিদা :
শিশু পিতা-মাতা বা বয়স্কদের কাছ থেকে দৈহিক নিরাপত্তা চায়। যেমন- নিরাপদ আশ্রয়, খাদ্য, বস্ত্র, জল, বায়ু প্রভৃতি।
(d) সক্রিয়তার চাহিদা :
কোনো শিশুই চুপ করে থাকতে চায় না। সবসময় সে কিছু না কিছু করতে চায়। তার ইচ্ছামতো চলাফেরা, নড়াচড়া ও দৌড়োদৌড়িতে বাধা দিলে সে বিরত হয়।
(e) পুনরাবৃত্তির চাহিদা :
শিশুর মধ্যে পুনরাবৃত্তির চাহিদা লক্ষ করা যায়। একই কথা সে বারবার বলে, একই কাজ সে বারবার করতে চায়।
2. মানসিক চাহিদা :
শৈশবে শিশুর দৈহিক চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে কতকগুলি মানসিক চাহিদা দেখা দেয়া। এই চাহিদাগুলি হল-
(a) অনুকরণের চাহিদা :
শিশু তার বাবা-মা কিংবা অন্যান্য বয়স্কদের নানান আচার-আচরণ অনুকরণ করে। এই অনুকরণই হল শৈশবকালীন আচরণের অন্যতম উৎস।
(b) আয়ত্তে আনার চাহিদা :
শিশু সবকিছুকে নিজের আয়তে আনতে চায়। শিশু যা দেখে তাই নিতে চায় ও পেতে চায়। নিজের জিনিস সে অন্যকে দিতে চার না।
(c) জানার চাহিদা :
শিশুর মধ্যে সবকিছু জানার চাহিদা দেখা দেয়। কী, কেন এইসব প্রশ্নের উত্তর সে চায়। এই চাহিদার ফলে অনেক সময় সে কোনো জিনিসকে ভেঙে তার ভেতরে কী আছে তা দেখতে চায়।
(d) কল্পনা করার চাহিদা :
শিশু কল্পনাপ্রবণ। সে গল্প শুনে কল্পনায় রূপকথার রাজ্যে বিলোপ করে আনন্দ পায়।
3. সামাজিক চাহিদা :
শিশু জন্মার সামাজিক পরিবেশে। সামাজিক পরিবেশের মধ্যেই তার বিকাশ ঘটে। তাই তার মধ্যে কতকগুলি সামাজিক চাহিদা পরিলক্ষিত হয়। এই চাহিদাগুলি হল—
(a) দলবদ্ধ হত্তয়ার চাহিদা :
কোনো শিশুই একা থাকতে চায় না। সে তার বন্ধুদের সঙ্গে দল বেঁধে থাকাটাই পছন্দ করে।
(b) সমবেদনার চাহিদা :
শিশু কোনো কারণে শরীরে বাধা পেলে পিতা-মাতা ও অন্যান্য বয়স্কদের কাছ থেকে সমবেদনা প্রত্যাশা করে।
(c) প্রতিদ্বন্দ্বিতার চাহিদা :
শিশুরা তাদের লক্ষ্যে পৌঁছোনোর জন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়।
(d) সহযোগিতার চাহিদা :
শিশুরা বড়োদের কাছ থেকে সব কাজে সহযোগিতা পেতে চায়। এই চাহিদা পুরণের জন্য বিভিন্ন আচরণের মাধ্যমে তারা বড়োদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
শৈশবের উপরিউক্ত চাহিদার সঙ্গে সামণ্ডুসা রেখে শৈশবের শিক্ষাব্যবস্থা রচনা করা প্রয়োজন।
Thanks siksakul