জি. স্ট্যানলি লিখিত Adolescence ইতে বাল্যকাল সুন্দরভাবে বর্ণিত হয়েছে। জীবনবিকাশের এক অনন্য স্তর হল বাল্যকাল। এই স্তরে মস্তিষ্ক আকারে ও ওজনে প্রাপ্তবয়স্কদের মতো হয়। সবচেয়ে ভালো স্বাস্থ্য বাল্যকালেই দেখা যায়। কার্যাবলির বৈচিত্র্যা ও পরিমাণও এই স্তরেই সবচেয়ে বেশি হয়। এই ব্যাসেই সহ্যশক্তি ও সাক্ষীবতা বৃদ্ধি পায়। সহজে ক্লান্তি আসে না। এই বয়সেই পরিবারের বাইরে একটা জীবন তৈরি হয় এবং এই ব্যাসের শিশুদের স্বাভাবিক আগ্রহ ব্যাস্তদের প্রভাবমুক্ত হতে চায়।
Q. শিশুর বাল্যকালের বিকাশগত বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করো ?
শৈশবকালের মতোই বাল্যকালের বিকাশগত বৈশিষ্ট্যগুলিকেও চারটি ভাগে ভাগ করা যায়, যথ—
1. শারীরিক বিকাশ।
2. মানসিক বিকাশ।
3. প্রাক্ষোভিক বিকাশ।
4. সামাজিক বিকাশ।
এই প্রতিটি পর্যায়ের বিকাশকে পৃথকভাবে আলোচনা করা প্রয়োজন।
1. শারীরিক বিকাশ :
বাল্যকালে শিশুর মধ্যে যেসব শারীরিক বিকাশ লক্ষ করা যায়, সেগুলি হল –
(A) বিশেষ করে পরবর্তী বাল্যকালে দৈর্ঘ্য ও ওজন বৃদ্ধি অপেক্ষাকৃত ধীরে হয়।
(B) বালিকারা দৈহিক বিকাশে দু-বছর এগিয়ে থাকে।
(C) এই বয়সে শারীরিকভাবে সমস্ত দিকেই পরিবর্তন দেখা যায়।
(D) শারীরিক অসুস্থতা এই বয়সে কম দেখা যায়।
(E) শৈশবের দাঁত পড়ে গিয়ে নতুন দাঁত তৈরি হয়।
(F) মুখমণ্ডলের পরিবর্তন হয়। কপাল চওড়া হয়, নাক তীক্ষ্ণ হয়, মুখমণ্ডল বিস্তৃত হয়, খেলাধুলোর মাধ্যমে পেশিগত সঞ্চালনশীলতার বিকাশ হয়।
2. মানসিক বিকাশ :
বাল্যকালের গুরুত্বপূর্ণ মানসিক বিকাশগুলি হল –
(A) বালক বা বালিকা মনোজগৎ ও বহির্বিশ্বের মধ্যে পার্থক্য পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারে।
(B) 12 বছরের মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মগুলি সম্পর্কে ধারণা গড়ে ওঠে।
(C) এই বয়সেই সংগৃহীত তথ্য ও চিন্তাভাবনাগুলি আত্মস্থ করার আগ্রহ দেখা যায়। প্রথাগত বিদ্যালয়ের শিক্ষা শুরু হওয়ার ফলে শিখন ও স্মৃতির উৎকর্ষ বৃদ্ধি ঘটে।
(D) যুক্তিসম্মত কারণ ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
(E) প্রত্যক্ষ বিষয়কেন্দ্রিক জ্ঞানের প্রয়োগ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
(F) বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প এবং যান্ত্রিত প্রক্রিয়ার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়।
(G) সাহস ও আনুগতা বৃদ্ধি পায়। কোনো কিছু করার ক্ষেত্রে এই বয়সের বালকরা সাহসী হয়।
(H) 10 থেকে 12 বছরের বালকদের সাধারণ জ্ঞান যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়।
3. প্রক্ষোভিক বিকাশ :
বাল্যকালে শিশুদের প্রাক্ষোভিক বিকাশের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল –
(A) এই বয়সে শৈশবকালীন প্রক্ষোভের ব্যাপক পরিবর্তন দেখা যায়।
(B) পরবর্তী বাল্যকালে সামাজিক পরিস্থিতি অনুযায়ী আবেগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা জন্মায়। আবেগের বিকাশ পরবর্তী স্তরের মতো সামগ্রিক হয় না, তা নির্দিষ্ট রূপ পায়।
(C) বয়স্কদের অবহেলা, সমবয়স্কদের পরিহাস, সহপাঠীদের সঙ্গে তুলনা এই বয়সি বালক-বালিকাদের ক্রোধের কারণ হয়।
(D) উল্লাস, আনন্দ, ভালোবাসা, কৌতূহল, বিষাদ এই বয়সের ছেলেমেয়েদের মধ্যে দেখা যায়। আবেগ প্রকাশে বস্তুর উপস্থিতি অপরিহার্য নয়।
(E) শৈশবকালের জন্তুভীতি এবং শব্দভীতি এই সময়ে দূর হয়। ভূতের এবং কাল্পনিক জীবের প্রতি ভয় আর থাকে না।
4. সামাজিক বিকাশ :
সামাজিক বিকাশের ক্ষেত্রেও এই পর্যায়ে শিশুর মধ্যে নানা পরিবর্তন দেখা যায়। এগুলি হল –
(A) দল গঠনের মানসিকতা :
এই সময়েই সমবয়সি বালক-বালিকাদের মধ্যে দল তৈরি হয় এবং গৃহপরিবেশের বাইরে তাদের মধ্যে মেলামেশা ও বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। এই দল (Peer Group) সামাজিকীকরণে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করে।
(B) উচ্ছাসের প্রাবল্য :
এই বয়সে বালক-বালিকারা বাড়িতে ও বিদ্যালয়ে প্রবল উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে যা অনেকসময় নিয়মশৃঙ্খলার বিরোধী হয়ে ওঠে। অবাধ্যতার ঘটনা এই বয়সে সবচেয়ে বেশি। ঘটে। বয়স্কদের আরোপিত শৃঙ্খলার গণ্ডি এই বয়সের ছেলেমেয়েরা মানতে চায় না। কিন্তু নিজেদের দলের নিয়মকানুন তারা মেনে চলে।
(C) সমলিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ :
সমলিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে। বালকেরা বালকদের নিয়ে, বালিকারা বালিকাদের নিয়ে দল গঠন করে।
(D) নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশ :
এই বয়সে দলগত চেতনার বিকাশ হয় ও আত্মকেন্দ্রিকতা হ্রাস পায়। সহযোগিতার মানসিকতা এবং নৈতিক মূল্যবোধ গড়ে ওঠে।
উপরিউক্ত বৈশিষ্ট্যের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, শৈশবের তুলনায় বালোর বিকাশগত বৈশিষ্ট্য অনেক বেশি সংহত ও তাৎপর্যপূর্ণ। শিক্ষার ক্ষেত্রে এই সময়টি হল প্রাথমিক শিক্ষার স্তর।
Q. বাল্যকাল শিশুর কি কি চাহিদা থাকে তা আলোচনা করো ?
বাল্যকালের চাহিদা :
বাল্যকালের বিকাশগত বৈশিষ্ট্যকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন চাহিদার সৃষ্টি হয়ে থাকে। ওইসব চাহিদার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল –
(A) শারীরিক।
(B) মানসিক।
(C) সামাজিক চাহিদা।
এই চাহিদাগুলির সম্পর্কে এখানে আলোচনা করা হল।
(A) বাল্যকালে শিশুর শারীরিক চাহিদা :
বাল্যকালের শারীরিক চাহিদাগুলির মধ্যে অন্যতম হল –
(i) সক্রিয়তার চাহিদা : এই বয়সি শিশুদের মধ্যে অধিক সক্রিয়তা দেখা যায়।
(ii) খাদ্যের চাহিদা : অতিসক্রিয়তার কারণে বাল্যকালে খাদ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। তারা নিজেদের পছন্দমতো খাবার খেতে চায়।
(iii) পুনরাবৃত্তির চাহিদা : শৈশবের মতো জীবনবিকাশের এই স্তরেও শিশুরা একই কাজ বারবার করতে চায়।
(B) বাল্যকালে শিশুর মানসিক চাহিদা :
বাল্যকালের গুরুত্বপূর্ণ মানসিক চাহিদাগুলি হল –
(i) নিরাপত্তার চাহিদা : বালক বালিকারা বয়স্কদের ও তাদের দলের সদস্যদের থেকে নিরাপত্তা প্রত্যাশা করে।
(ii) সাহসিকতার চাহিদা : এই স্তরের শিশুদের মধ্যে সাহসী কাজকর্ম করার তাগিদ বৃদ্ধি পায়। দৈহিক শক্তি ও নিজের প্রতি আস্থাবৃদ্ধি, বয়স্কদের নিয়মকানুনের প্রতি গুরুত্ব আরোপ না করার প্রবণতা এবং দলের মধ্যে নিজের অবস্থানকে মর্যাদা দেওয়ার উদ্দেশ্যে বালক-বালিকাদের মধ্যে সাহসিকতার চাহিদা দেখা যায়।
(iii) জ্ঞানের চাহিদা : বাল্যকালে জ্ঞানের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। অচেনাকে চেনার এবং অপনাকে, বিশেষ করে বিজ্ঞানবিষয়ক ঘটনাকে জানার কৌতূহল এই বয়সের অন্যতম চাহিদা।
(iv) অনুসন্ধান ও অনুকরণের চাহিদা : বাল্যকালের শিশুদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়কে গভীরভাবে বিচার করার চাহিদা দেখা যায়। শৈশবকালের মতো বয়স্কদের, বিশেষ করে শিক্ষকদের অনুকরণ করতে চায় এরা।
(v) দায়িত্ব পালনের চাহিদা : এই স্তরের শিশুদের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে নানারকম দায়িত্ব পালনে এরা উৎসাহ দেখায়।
(C) বাল্যকালে শিশুর সামাজিক চাহিদা :
বাল্যকালে সামাজিক বিকাশ ব্যাপকতা লাভ করে। এগুলির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল –
(i) দল গঠনের চাহিদা : এই সময়ে সমবয়সি বালক-বালিকাদের মধ্যে দল গড়ে ওঠে। বাড়ির বাইরে তাদের মধ্যে মেলামেশা, বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। এই দল (Peer Group) সামাজিকীকরণে বিশেষভাবে অংশগ্রহণ করে।
(ii) উচ্ছাসের প্রাধান্য : এই বয়সি বালক-বালিকাদের মধ্যে ঘরে ও বিদ্যালয়ে প্রচন্ড উচ্ছ্বাস দেখা যায় যা অনেক সময় শৃঙ্খলা মেনে চলে না।
(iii) অবাধ্যতা এবং দলের প্রতি আনুগত্য : এই বয়সেই অবাধ্যতার ঘটনা সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। বয়স্তদের আরোপিত শৃঙ্খলা এরা মানতে চায় না কিন্তু নিজেদের দলের নিয়মকানুনগুলি মেনে চলে।
(iv) অপরাধপ্রবণতা : বয়ঃসন্ধিকালের চেয়ে এই বয়সের বালক-বালিকাদের অধিক অপরাধপ্রবণতা দেখা যায়।
(v) সমলিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ : লিঙ্গগত পার্থক্য সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। বালকেরা বালকদের সঙ্গে ও বালিকারা বালিকাদের সঙ্গে মেলামেশা করে।
(vi) আক্রমণধর্মিতা : বালকেরা বালিকাদের থেকে অধিক আক্রমণধর্মী এবং সংগঠিত হয়।
(vii) দলগত চেতনার বিকাশ এবং সহযোগিতার মনোভাব : এই ব্যাসের বালক বালিকারা দলগত ক্রীড়ার প্রতি আকৃষ্ট হয়। তাদের মধ্যে স্বার্থপরতা, আত্মকেন্দ্রিকতা হ্রাস পায়। সহযোগিতার মানসিকতা গড়ে ওঠে।
উপরিউক্ত বৈশিষ্ট্যের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, শৈশবের তুলনায় বাল্যের বিকাশগত বৈশিষ্ট্য অনেক বেশি সংহত। জীবনবিকাশের এই স্তরটি তাই ভবিষ্যতের একজন সুস্থ এবং সক্রিয় নাগরিক গড়ে ওঠার পক্ষে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।