1954 খ্রিস্টাব্দে মানবতাবাদী মনোবিদ ম্যাসলো তাঁর (Need Hierarchy Theory of Maslow In Bengali) তত্ত্বে বাকির চাহিদাকে একটি পিরামিড আকারে প্রকাশ করেছেন। এই পিরামিডের সবচেয়ে নীচে রয়েছে শারীরবৃত্তীয় চাহিদা বা অস্তিত্ব চাহিদা যার মধ্যে রয়েছে খাদ্য, জগ, আত্মা ইত্যাদি। দ্বিতীয় স্তরে রয়েছে নিরাপত্তার চাহিদা, যা দৈহিক বা মানসিক উভয় ধরনেরই হতে পারে। তৃতীয় স্তরটি হল ভালোবাসা ও একাত্মতার চাহিদা, যাকে অন্তর্ভুক্তির চাহিদাও বলা যেতে পারে। চতুর্থ স্তরটিতে রয়েছে আত্মশ্রদ্ধা বা আত্মসম্মানের চাহিদা এবং সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে আবাপ্রতিষ্ঠা বা আত্মপ্রকাশের চাহিদা। এই সমস্ত চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন ধরনের প্রেষণার সৃষ্টি হয়। ওই চাহিদাগুলি ও তার সঙ্গে সম্পর্কিত প্রেষণাগুলি নীচে আলোচনা করা হলো –
(1) শারীরবৃত্তীয় চাহিদা বা অস্তিত্ব রক্ষার চাহিদা (Physiological Need) :
মানুষের জীবনধারণের জন্য যে চাহিদাগুলি প্রয়োজন সেগুলিকেই শারীরবৃত্তীয় চাহিদা বলে। জল, বাতাস, আলো, ক্ষুধা, ভূমা, নিল্লা ইত্যাদি হল মানুষের শারীরবৃত্তীয় চাহিদা। চাহিদাগুলি ব্যক্তির মধ্যে জন্মগতভাবে থাকে। এই চাহিদাগুলি পূরণ না হলে পরবর্তী পর্যায়ের চাহিদা পূরণের জন্য প্রেষণার সৃষ্টি হয় না। তাই প্রেষণা সৃষ্টির জন্য প্রথমে দেখতে হবে, যেসব শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে তাদের মধ্যে এই চাহিদাগুলি আছে কিনা। ওই চাহিদাগুলি যদি পূরণ না হয় তাহলে শিক্ষার জন্য পরিবেশ যতই আদর্শ হোক না কেন শিক্ষার্থীদের মধ্যে কাজের প্রেষণা সবার করা সম্ভব হবে না। এই কারণে এই চাহিদাগুলিকে প্রাথমিক চাহিদা বলে।
বর্তমানে আমাদের দেশে বিভিন্ন প্রাদেশিক সরকার অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলিতে Mid-day Meal, পোশাক, বই ইত্যাদি বিনামূল্যে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। এর উদ্দেশ্য হল শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক চাহিদাগুলি পুরণ করা, যাতে তারা পরবর্তী পর্যায়ে উন্নত চাহিদাগুলি পুরণে সচেষ্ট হয়।
(2) নিরাপত্তার চাহিদা (Safety Need) :
মনোবিদ ম্যাসলো-এর মতে, বিভিন্ন চাহিদার মধ্যে নিরাপত্তার চাহিদা অন্যতম। সুরক্ষা, অস্তিত্ব, ভয় থেকে মুক্তি, উদ্কোহীনতা, সংহতি, সুস্পষ্টতার চাহিদা ইত্যাদি এই চাহিদার অন্তর্ভুক্ত। ব্যক্তির মধ্যে যদি ভয় থাকে, শৃঙ্খলার অভাব থাকে, স্বায়িত্ব সম্বন্ধে প্রশ্ন থাকে, বিভিন্ন ধরনের মানসিক দুশ্চিন্তা বা উদ্বেগের মধ্যে যদি তাকে জীবনযাপন করতে হয় তবে ব্যক্তির নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। ফলে কোনো কাজে তার মধ্যে প্রেষণা জাগানো সম্ভব হবে না। তাই প্রতিটি ব্যক্তির নিরাপত্তাকে সুনিশ্চিত করা হল গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য।
শিক্ষার্থী যদি শিক্ষককে ভয় পায়, শিক্ষকের থেকে যদি সঠিক উপদেশ না পায়, শিক্ষকের মধ্যে যদি সহযোগিতার মনোভাব বা সহমর্মিতার অভাব থাকে তাহলে শিক্ষার্থীরা নিরাপত্তার অভাব বোধ করবে, যার ফলে ওই শিক্ষার্থীরা শিখনে তেমন আগ্রহী হবে না। একইভাবে সহপাঠীরা যদি কোনো শিক্ষার্থীর প্রতি সঠিক আচরণ না করে তবে সেই শিক্ষার্থী নিরাপত্তার অভাব বোধ করে। সহপাঠীদের অবহেলা ও অমানবিক আচলাণ অনেক সময় প্রেষণা সৃষ্টিতে বাধা সৃষ্টি করে। শিক্ষক, সহপাঠী, অভিভাবক প্রমুখদের মিষ্টি আচরণ যেমন শিক্ষার্থীদের মানসিক শক্তি বাড়িয়ে দেয়, ঠিক তেমনি কর্কশ আচরণ তাদের শিক্ষাক্ষেত্রে প্রেষণা সৃষ্টিতে বাধা দান করে।
এই কারণেই শিক্ষকের কর্তব্য হল শিক্ষার্থীদের সঠিক পথ নির্দেশনা দেওয়া এবং প্রতিটি শিক্ষার্থীর প্রতি সহযোগিতা ও সহমর্মিতা প্রদর্শন করা।
(3) ভালোবাসা ও একাত্মতার চাহিদা (Needs for Love and Esteem) :
মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। প্রতিটি ব্যক্তি চায় মিলেমিশে থাকতে অর্থাৎ একাকিত্ব এড়িয়ে চলতে। ভালোবাসা, একাত্মতাবোধ প্রভৃতি সামাজিক চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে যে প্রেষণা জাগ্রত হয় তাদেরকে সামাজিক প্রেষণা বলে। এই প্রেষণা প্রতিটি ব্যক্তিকে সামাজিক আদর্শের পরিপ্রেক্ষিতে আচরণ সম্পাদনে প্রবৃত্ত করে। শিক্ষার্থীর জীবনে সামাজিক চেতনা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই ধরনের প্রেষণা বিকাশ শুরু হয়। পিতামাতা এবং শিক্ষকগণ শিক্ষার্থীদের এই চাহিদাপুরণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অবলম্বন করবেন।
(4) আত্মশ্রদ্ধা বা আত্মসম্মানের চাহিদা (Need for Respect) :
ম্যাসলো-র মতে, “All people need a stable, firmly based high evaluation of themselves.” অর্থাৎ প্রতিটি ব্যক্তি চাষ অন্যরা তাকে ব্যক্তি হিসেবে যথাযথ গুরুত্ব দিক। এই চাহিদা ব্যক্তির আত্মসচেতনতাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে এবং ব্যক্তির মধ্যে আত্মপ্রধার প্রেষণা গড়ে তোলে। এই ধরনের প্রেষণা জাগ্রত হওয়ার মূলে রয়েছে আমাদের প্রভোকেরা নিজেদের যোগ্যতা সময়ে ধারণা। আশখার প্রেষণা জাগ্রত হলে ব্যক্তির আত্মমর্যাদার চাহিদা দেখা দেয় এবং আত্মসম্মান রক্ষার জন্য সে সচেতন হয়। প্রথমদিকে এই চাহিদা বাবা, মা, অভিভাবক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হলেও বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেক ব্যপ্তি নিজেকে বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত রাখতে চায়, যার মাধ্যমে সে আত্মসম্মানের চাহিদাপুরণ করে।
শিক্ষকের কর্তব্য হল শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাতে তাদের যোগ্যতা, আত্মসম্মান বোধ সম্পর্কে সঠিক ধারণা জন্মে সেদিকে নজর দেওয়া। এ ছাড়াও সহপাঠীরা যাতে একে অপরকে যথাযথ মর্যাদা দেয় সেদিকে শিক্ষককে লক্ষ রাখতে হবে। আত্মশ্রদ্ধা বা আত্মসম্মানের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হলে বাকি বা শিক্ষার্থী কাজে প্রেষণা পাবে। শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এই প্রেষণা জীবনে সাফল্যলাভে সাহায্য করে ও উচ্চতর চাহিদা পূরণে অগ্রসর হতে পারে।
(5) আত্মপ্রতিষ্ঠার চাহিদা (Need for Self Actualisation) :
ব্যক্তির চাহিদার মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য চাহিদা হল আত্মপ্রতিষ্ঠার চাহিদা, যা ম্যাসলোর চাহিদার পিরামিডের সর্বোচ্চ স্তরে স্থান পেয়েছে। এই চাহিদার সঙ্গে যুক্ত প্রেষণাকে আত্মপ্রতিষ্ঠা বা আত্মপ্রকাশের প্রেষণা বলে। প্রতিটি বাকি চায় তার মধ্যে যে অন্তর্নিহিত শারীরিক ও মানসিক ক্ষমতা রয়েছে তার পরিপূর্ণ বিকাশ। প্রতিটি মানুষের মধ্যে আত্মপ্রকাশের চাহিদা রয়েছে। তবে এই ধরনের চাহিদা বা তাকে কেন্দ্র করে প্রেষণা সৃষ্টি করার জন্য ব্যক্তির অন্যান্য চাহিদাগুলিও পরিতৃপ্ত হওয়া দরকার। এই ধরনের প্রেষণার গুরুত্ব কৈশোরে সবচেয়ে বেশি হয়।
এই চাহিদা বা তার সকো সম্পর্কিত প্রেষণা ব্যক্তিকে আরও বেশি অনুপ্রাণিত করে ফলে নিজেকে আরও বেশি করে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রেষণা শিক্ষার্থীদের মধ্যে জাগ্রত করতে পারলে ভালো শিক্ষার্থী আরও ভালো ফল করার চেষ্টা করে।
এক্ষেত্রে শিক্ষকের কর্তব্য হল শিক্ষার্থীদের আচরণ অনুধাবন করা ও তাদেরকে আত্মপ্রতিষ্ঠা বা আত্মপ্রসারের জন্য উৎসাহিত করা।
আত্মশ্রদ্ধা বা আত্মসম্মান ও আত্মপ্রকাশ বা আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রেষণা শিক্ষা দ্বারা প্রভাবিত হয়। এই প্রেষণা দ্বারা সৃষ্ট কাজ ব্যক্তিকে যেমন তার ব্যক্তিগত চাহিদা পরিতৃপ্ত করতে সাহায্য করে অন্যদিকে তেমনি তার সামাজিক মর্যাদাও বৃদ্ধি করে। আলোচিত ম্যাসলোর পিরামিডাকার চাহিদার ক্রমপর্যায় থেকে বলা যায় যে, কোনো একটি চাহিদার সঠিক পরিতৃপ্তি না ঘটলে শিক্ষার্থীর শিক্ষা ব্যাহত হবে। ব্যক্তি তার সঠিক লক্ষ্যে পৌঁছোতে পারবে না। তাই শিক্ষকের কর্তব্য হবে এমন শিক্ষা পরিবেশ গড়ে তোলা যাতে শিক্ষার্থীর ক্রমপর্যায়ভিত্তিক চাহিদার পুরণ ঘটে এবং প্রেষণাগুলি সক্রিয় হয়ে ওঠে।
